Popular Posts

Monday, July 15, 2013

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : একাদশোহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)



অর্জ্জুন উবাচ -

মদনুগ্রহায় পরমং গুহ্যমধ্যাত্মসংজ্ঞিতম্
যৎ ত্বয়োক্তং বচস্তেন মোহোহয়ং বিগতো মম।।

সপ্তম অধ্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান আরম্ভ করিয়া সপ্তম ও অষ্টমে পরমেশ্বরের অক্ষর অথবা অব্যক্ত রূপের এবং নবম ও দশমে অনেক ব্যক্ত রূপের যে জ্ঞান বলিয়াছে, তাহাকেই অর্জ্জুন প্রথম শ্লোকে অধ্যাত্ম বলিয়াছেন।

অর্থঃ- (১) অর্জ্জুন বলিলেন, - তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া যে পরম গুহ্য অধ্যাত্ম-তত্ত্ব বর্ণন করিলে তাহাতে আমার এই মোহ বিদূরিত হইল।

আমার এই মোহ বিনষ্ট হইল অর্থাৎ তোমার প্রকৃত তত্ত্ব জানিয়া, তুমিই সর্ব্বভূতের নিয়ন্তা, সর্ব্ব কর্ম্মের নিয়ামক, ইহা বুঝিতে পারিইয়া আমি কর্ত্তা, আমার কর্ম্ম ইত্যাদি রূপে যে আমার মোহ তাহা অপগত হইল, আমি বুঝিতেছি, তুমিই কর্ত্তা, তুমিই যন্ত্রী, আমি যন্ত্রমাত্র।

ভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাং শ্রুতৌ বিস্তরশো ময়া
ত্বত্তঃ কমলপত্রাক্ষ মাহাত্ম্যমপি চাব্যয়ম্।।

অর্থঃ- (২) হে কমললোচন, ভূতগণের উৎপত্তি ও লয় এবং তোমার অক্ষয় মাহাত্ম্য- এ সকলই তোমার নিকট হইতে সবিস্তারে আমি শুনিলাম।

এবমেতদ্ যথাত্থ ত্বমাত্মানং পরমেশ্বর
দ্রষ্টুমিচ্ছামি তে রূপমৈশ্বরং পুরুষোত্তম।।

অর্থঃ- (৩) হে পরমেশ্বর, তুমি আপনার বিষয় যাহা বলিলে তাহা এইরূপ বটে; হে পুরুষোত্তম, আমি তোমার সেই ঐশ্বরিক রূপ দেখিতে ইচ্ছা করি।

তুমি পরমেশ্বর। আমি একাংশে জগৎ ধারণ করিয়া আছি ইত্যাদি যাহা তুমি বলিলে তাহা সত্য। আমার বড় ইচ্ছা হইতেছে আমি তোমার সেই বিশ্বরূপ দর্শন করি।

মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়হা দ্রষ্টুমিতি প্রভো
যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্।।

অর্থঃ- (৪) হে প্রভো! যদি তুমি মনে কর যে, আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহা হইলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ প্রদর্শন কর।

শ্রীভগবানুবাচ -

পশ্য মে পার্থ রূপাণি শতশোহথ সহস্রশঃ
নানাবিধানি দিব্যানি নানাবর্ণাকৃতীনিচ।।

অর্থঃ- (৫) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন, - হে পার্থ, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট শত শত সহস্র সহস্র বিভিন্ন অবয়ববিশিষ্ট আমার এই অদ্ভূত রূপ দর্শন কর।

পশ্যাদিত্যান্ বসুন্ রুদ্রানশ্বিনৌ মরুতস্তথা
বহুন্যদৃষ্টপূর্ব্বাণি পশ্যাশ্চর্য্যাণি ভারত।।

অর্থঃ- (৬) হে ভারত, এই আমার দেহে দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, এবং ঊনপঞ্চাশৎ মরুদ্‌গণ দর্শন কর; পূর্ব্বে যাহা কখনও দেখ নাই, তেমন বহুবিধ আশ্চর্য্য বস্তু দর্শন কর।

ইহৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং পশ্যাদ্য সচরাচরম্
মম দেহে গুড়াকেশ যচ্চান্যদ্ দ্রষ্টুমিচ্ছসি।।

অর্থঃ- (৭) হে অর্জ্জুন, আমার এই দেহে একত্র অবস্থিত চরাচর সমগ্র জগৎ দর্শন কর এবং অপর যাহা কিছু তুমি দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহাও এখন দেখিয়া লও।

অপর যাহা কিছু এ কথার তাৎপর্য্য এই যে, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান ত্রিকালের যত কিছু ঘটনা সকলি আমার এই দেহে বিদ্যমান। এই যুদ্ধের জয়-পরাজয়াদি ভবিষ্যৎ ঘটনা যাহা দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহাও এই দেহে দেখিতে পাইবে (১১।১৬-৩৩ ইত্যাদি শ্লোক দ্রষ্টব্য)।

নতু মাং শক্যসে দ্রষ্টস্মনেনৈব স্বচক্ষুষা
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।।

অর্থঃ- (৮) হে অর্জ্জুন, তুমি তোমার এই চর্ম্মচক্ষুদ্বারা আমার এই রূপ দর্শনে সমর্থ হইবে না। এজন্য তোমাকে দিব্যচক্ষু দিতেছি, তদ্দারা আমার এই ঐশ্বরিক যোগসামর্থ্য দেখ।

সঞ্জয় উবাচ -

এবমুক্তা ততো রাজন্ মহাযোগেশ্বরো হরিঃ
দর্শয়ামাস পার্থায় পরমং রূপমৈশ্বরম্।।

অর্থঃ- (৯) সঞ্জয় কহিলেন - হে রাজন্‌ মহাযোগেরশ্বর হরি এইরূপ বলিয়া তৎপর পার্থকে পরম ঐশ্বরিক রূপ দেখাইলেন।

অনেকবক্ত্রনয়নমনেকাদ্ভুতদর্শনম্
অনেকদিব্যাভরণং দিব্যানেকোদ্যতায়ুধম্।।১০

অর্থঃ- (১০) সেই ঐশ্বরিক রূপে অসংখ্য মুখ, অসংখ্য নেত্র, অসংখ্য অদ্ভুত অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু, অসংখ্য দিব্য আভরণ এবং অসংখ্য উদ্যত দিব্যাস্ত্রসকল বিদ্যমান (ছিল)।

দিব্যমাল্যান্বরধরং দিব্যগন্ধানুলেপনম্
সর্ব্বাশ্চর্য্যময়ং দেবমনন্তং বিশ্বতোমুখম্।।১১

অর্থঃ- (১১) সেই বিশ্বরূপ দিব্য মাল্য ও দিব্য বস্ত্রে সুশোভিত, দিব্যগন্ধদ্রব্যে অনুলিপ্ত, সর্ব্বাশ্চর্য্যময়, দ্যুতিমান্‌ অনন্ত ও সর্ব্বতোমুখ (সর্ব্বত্র মুখবিশিষ্ট) (ছিল)।

দিবি সূর্য্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।।১২

অর্থঃ- (১২) আকাশে যদি যুগপৎ সহস্র সূর্য্যের প্রভা উত্থিত হয়, তাহা হইলে সেই সহস্র সূর্য্যের প্রভা মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভাব তুল্য হইতে পারে।

এই শ্লোকে অপূর্ব্ব শব্দবিন্যাসকৌশলে শব্দের ধ্বনি দ্বারাই কিরূপে অর্থ দ্যোতনা হইতেছে, তাহা লক্ষ্য করিবার বিষয়।

তত্রৈকস্থং জগৎ কৃৎস্নং প্রবিভক্তমনেকধা
অপশ্যদ্দেবদেবস্য শরীরে পাণ্ডবস্তদা।।১৩

অর্থঃ- (১৩) তখন অর্জ্জুন সেই দেবদেবের দেহে নানা ভাবে বিভক্ত তদীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বরূপ একত্রস্থিত সমগ্র জগৎ দেখিয়াছিলেন।

ততঃ স বিস্ময়াবিষ্টো হৃষ্টরোমা ধনঞ্জয়ঃ
প্রণম্য শিরসা দেবং কৃতাঞ্জলিরভাষত।।১৪

অর্থঃ- (১৪) সেই বিশ্বরূপ দর্শন করিয়া ধনঞ্জয় বিস্ময়ে আপ্লুত হইলেন। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তিনি অবনতমস্তকে সেই দেবদেবকে প্রণাম করিয়া করজোরে বলিতে লাগিলেন।

অর্জ্জুন উবাচ -

পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে সর্ব্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থমৃষীংশ্চ সর্ব্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্।।১৫

অর্থঃ- (১৫) অর্জ্জুন বলিলেন - হে দেব, তোমার দেহে আমি সমস্ত দেবগণ, স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিবিধ সৃষ্ট পদার্থ, সৃষ্টিকর্ত্তা কমলাসনস্থ ব্রহ্মা, নারদ-সনকাদি দিব্য কবিগণ এবং অনন্ত্য-তক্ষকাদি সর্পগণকে দেখিতেছি।

অনেক বাহূদরবক্ত্রনেত্রং পশ্যামি তাং সর্ব্বতোহনন্তরূপম্
নান্তং ন মধ্যং ন পুনস্তবাদিং পশ্যামি বিশ্বেশ্বর বিশ্বরূপ।।১৬

অর্থঃ- (১৬) অসংখ্য বাহু, উদর, বদন ও নেত্রবিশিষ্ট অনন্তরূপ তোমাকে সকল দিকেই আমি দেখিতেছি। কিন্তু হে বিশ্বেশ্বর, হে বিশ্বরূপ, আমি তোমার আদি, অন্ত, মধ্য, কোথাও কিছু দেখিতেছি না।

কিরীটিনং গদিনং চক্রিণঞ্চ তেজোরাশিং সর্ব্বতো দীপ্তিমন্তম্
পশ্যামি ত্বাং দুর্নিরীক্ষ্যং সমন্তাদ্ দীপ্তানলার্কদ্যুতিমপ্রমেয়ম্।।১৭

অর্থঃ- (১৭) কিরীট, গদা ও চক্রধারী, সর্ব্বত্র দীপ্তিশালী, তেজঃপুঞ্জস্বরূপ, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্য্যের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন, দুর্নিরীক্ষ্য, অপরিমেয় তোমার অদ্ভূত মুর্ত্তি সর্ব্বদিকে সর্ব্বস্থানে আমি দেখিতেছি।

ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে।।১৮

অর্থঃ- (১৮) তুমি অক্ষর পরব্রহ্ম, তুমি একমাত্র জ্ঞাতব্য তত্ত্ব, তুমিই এই বিশ্বের পরম আশ্রয়, তুমিই সনাতন ধর্ম্মের প্রতিপালক, তুমি অব্যয় সনাতন পুরুষ, ইহাতে আমার সংশয় নাই।

অনাদিমধ্যান্তমনন্তবীর্য্যমনন্তবাহুং শশিসুর্য্যনেত্রম্
পশ্যামি ত্বাং দীপ্তহুতাশবক্ত্রং স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপন্তম্।।১৯

অর্থঃ- (১৯) আমি দেখিতেছি, তোমার আদি নাই, মধ্য নাই, অন্ত নাই, তোমার বলৈশ্বর্য্যের অবধি নাই, অসংখ্য তোমার বাহু, চন্দ্র সূর্য্য তোমার নেত্রস্বরূপ, তোমার মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত হুতাশন জ্বলিতেছে; তুমি স্বীয় তেজে নিখিল বিশ্বকে সন্তাপিত করিতেছ।

অনন্ত বাহু, আদি অন্ত মধ্যহীন ইত্যাদি বর্ণনা পূর্ব্বে করা হইয়াছে। কিন্তু হর্ষ-বিস্ময়াদি রসের বর্ণনায় পুনরুক্তি দোষজনক হয় না - প্রমাদে বিস্ময়ে হর্ষে দ্বিস্ত্রিরুক্তং ন দুষ্যতি।

দ্যাবাপৃথিব্যোরিদমন্তরং হি ব্যাপ্তং ত্বয়ৈকেন দিশশ্চ সর্ব্বাঃ
দৃষ্ট্বাদ্ভুতং রূপমুগ্রং তবেদং লোকত্রয়ং প্রব্যথিতং মহাত্মন্।।২০

অর্থঃ- (২০) হে মহাত্মন্‌, একমাত্র তুমিই স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যস্থল এই অন্তরীক্ষ এবং দিক্‌সকলও ব্যাপিয়া রহিয়াছ। তোমার এই অদ্ভূত উগ্রমূর্ত্তি দর্শন করিয়া ত্রিলোক ব্যথিত হইতেছে।

অর্জ্জুন বিশ্বরূপ ব্যতীত আর কিছুই দেখিতেছেন না এবং তিনি এই রূপ দেখিয়া স্বয়ং অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন। ত্রিলোক ভীত হইয়াছে যে বলিতেছেন উহা তাঁহারই মনের ভাব মাত্র। বস্তুতঃ অর্জ্জুন ব্যতীত আর কেহ বিশ্বরূপ দেখিতে পারে না, দেখেও নাই।

অমী হি ত্বাং সুরসঙ্ঘা বিশন্তি কেচিদ্ভীতাঃ প্রাঞ্জলয়ো গৃণন্তি
স্বস্তীত্যুক্ত্বা মহর্ষিসিদ্ধসঙ্ঘাঃ স্তুবন্তি ত্বাং স্তুতিভিঃ পুষ্কলাভিঃ।।২১

অর্থঃ- (২১) ঐ দেবতাগণ তোমাতেই প্রবেশ করিতেছেন। কেহ কেহ ভীত হইয়া (জয় জয়, রক্ষ রক্ষ ইত্যাদি বাক্যে) কৃতাঞ্জলিপুটে রক্ষা প্রার্থনা করিতেছেন, মহর্ষি ও সিদ্ধগণ স্বস্তি স্বস্তি বলিয়া উত্তম সারগর্ভ স্তোত্রসমূহদ্বারা তোমার স্তব করিতেছেন।

রুদ্রাদিত্যা বসবো যে চ সাধ্যা বিশ্বেহশ্বিনৌ মরুতশ্চোষ্মপাশ্চ
গন্ধর্ব্বযক্ষাসুরসিদ্ধসঙ্ঘা বীক্ষন্তে ত্বাং বিস্মিতাশ্চৈব সর্ব্বে।।২২

অর্থঃ- (২২) একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, সাধ্যনামক দেবগণ, বিশ্বদেবগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ঊনপঞ্চাশ মরুৎ, উষ্মপা (পিতৃগণ), গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, অসুর ও সিদ্ধগণ সকলেই বিশ্ময়াবিষ্ট হইয়া তোমাকে দর্শন করিতেছেন।

রুপং মহত্তে বহুবক্ত্রনেত্রং মহাবাহো বহুবাহূরূপাদম্
বহুদরং বহুদংষ্ট্রাকরালং দৃষ্ট্বা লোকাঃ প্রব্যথিতাস্তথাহম্।।২৩

অর্থঃ- (২৩) হে মহাবাহো, বহু বহু মুখ, নেত্র, বাহু, ঊরু, পাদ ও উদর বিশিষ্ট এবং বহু বৃহদাকার দন্ত দ্বারা ভয়ঙ্করদর্শন তোমার এই সুবিশাল মূর্ত্তি দেখিয়া লোকসকল ভীত হইয়াছে এবং আমিও ভীত হইয়াছি।

নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্
দৃষ্ট্বাহি ত্বাং প্রব্যথিতান্তরাত্মা ধৃতিং ন বিন্দামি শমঞ্চ বিষ্ণো।।২৪

অর্থঃ- (২৪) হে বিষ্ণো, নভঃস্পর্শী, তেজোময়, বিস্ফারিত-নয়ন, অত্যুজ্জল বিশালনেত্র-বিশিষ্ট তোমার রূপ দেখিয়া আমার অন্তরাত্মা ব্যথিত হইতেছে, আমার দেহেন্দ্রিয় বিকল হইতেছে, আমি মনকে শান্ত করিতে পারিতেছি না।

দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্ট্বৈব কালানলসন্নিভানি
দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম্ম প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস।।২৫

অর্থঃ- (২৫) বৃহৎ দন্তসমূহের দ্বারা ভয়ানক দর্শন, প্রলয়াগ্নি সদৃশ তোমার মুখসকল দর্শন ঘটিতেছে (আমি দিশেহারা হইয়াছি), আমি স্বস্তি পাইতেছি না। হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, প্রসন্ন হও (আমার ভয় দূর কর)।

অমী চ ত্বাং দৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ সর্ব্বে সহৈবাবনিপালসঙ্ঘৈ
ভীষ্মো দ্রোণঃ সূতপুত্রস্তথাসৌ সহাস্মদীয়ৈরপি যোধমুখ্যৈঃ।।২৬
বক্ত্রাণি তে ত্বরমাণা বিশন্তি দংষ্ট্রাকরালানি ভয়ানকানি
কেচিদ্ বিলগ্না দশনান্তরেষু সংদৃশ্যন্তে চুর্ণিতৈরুত্তমাঙ্গৈঃ।।২৭

অর্থঃ- (২৬-২৭) ( জয়দ্রথাদি ) রাজন্যবর্গসহ ঐ সকল ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং আমাদের প্রধান প্রধান যোদ্ধগণ তোমার দংষ্ট্রাকরাল ভয়ঙ্করদর্শন মুখগহভরে গিয়াছে এবং উহা তোমার দন্তসন্ধিতে সংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে দেখা যাইতেছে।

যথা নদীনাং বহবোহন্বুবেগাঃ সমুদ্রমেবাভিমুখা দ্রবন্তি
তথা তবামী নরলোকবীরাঃ বিশন্তি বক্ত্রাণ্যভিবিজ্বলন্তি।।২৮

অর্থঃ- (২৮) যেমন নদীসমূহের বহু জলপ্রবাহ সমুদ্রাভিমুখ হইয়া সমুদ্রে গিয়া প্রবেশ করে, সেইরূপ এই মনুষ্য লোকের বীরগণ তোমার সর্ব্বতোব্যাপ্ত জলন্ত মুখগহবরে প্রবেশ করিতেছে।

যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকান্তবাপি বক্ত্রাণি সমৃদ্ধবেগাঃ।।২৯

অর্থঃ- (২৯) যেমন পতঙ্গগণ অতি বেগে ধাবমান হইয়া মরণের জন্য জলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করে, সেইরূপ এই লোকসকল মরণের নিমিত্তই অতি বেগে তোমার মুখ-গহবরে প্রবেশ করিতেছে।

লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তাল্লোকান্ সমগ্রান্ বদনৈর্জ্বলদ্ভিঃ
তেজোভিরাপূর্য্য জগৎ সমগ্রং ভাসস্তবোগ্রাঃ প্রতপন্তি বিষ্ণো।।৩০

অর্থঃ- (৩০) তুমি জ্বলন্ত মুখসমূহের দ্বারা লোকসমূহকে গ্রাস করিয়া বারংবার স্বাদগ্রহণ করিতেছ। মগ্র জগৎ তোমার তীব্র তেজোরাশি-ব্যাপ্ত হইয়া প্রতপ্ত হইয়া উঠিয়াছে

আখ্যাহি মে কো ভবানুগ্ররূপো নমোহস্তু তে দেববর প্রসীদ
বিজ্ঞাতুমিচ্ছামি ভবন্তমাদ্যং নহি প্রজানামি তব প্রবৃত্তিম্।।৩১

অর্থঃ- (৩১) উগ্রমূর্ত্তি আপনি কে, আমাকে বলুন। হে দেববর, আপনাকে প্রণাম করি, প্রসন্ন হউন। আদি পুরুষ আপনাকে আমি জানিতে ইচ্ছা করি। আপনি কে, কি কার্য্যে প্রবৃত্ত, বুঝিতেছি না।

আমি আপনার বিশ্বরূপ ও বিভূতিসমূহ দেখিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু আপনার এই সংহারমূর্ত্তি দেখিয়া আমি বুঝিতেছি না, আপনি কে ও কি কার্য্যে প্রবৃত্ত।

শ্রীভগবানুবাচ -

কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্ত্তুমিহ প্রবৃত্তঃ
ঋতেহপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্ব্বে যেহবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ।।৩২

অর্থঃ- (৩২) শ্রীভগবান্‌ কহিলেন - আমি লোকক্ষয়কারী অতি ভীষণ কাল; এক্ষণে এই লোকদিগকে সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি; তুমি যুদ্ধ না করিলেও প্রতিপক্ষ সৈন্যদলে যে সকল যোদ্ধা অবস্থান করিতেছে তাহারা কেহই থাকিবে না।

তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব জিত্বা শত্রুন্ ভুঙ্ ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম্
ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্ব্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।।৩৩

অর্থঃ- (৩৩) অতএব, তুমি যুদ্ধার্থ উত্থিত হয়; শত্রু জয় করিয়া যশঃ লাভ কর, নিষ্কন্টক রাজ্য ভোগ কর। হে অর্জ্জুন, আমি ইহাদিগকে পূর্ব্বেই নিহত করিয়াছি; তুমি এক্ষণ নিমিত্ত-মাত্র হও।

দ্রোণঞ্চ ভীষ্মঞ্চ জয়দ্রথঞ্চ কর্ণং তথান্যানপি যোধবীরান্
ময়া হতাংস্ত্বং জহি মা ব্যথিষ্ঠাঃ যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান্।।৩৪

অর্থঃ- (৩৪) দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ, কর্ণ এবং অন্যান্য যুদ্ধবীরগণকে আমি পূর্ব্বেই নিহত করিয়া রাখিয়াছি, তুমি সেই হতগণকে হত করঃ ভয় করিও না। রণে শত্রুগণকে নিশ্চয় নিহত করিতে পারিবে, যুদ্ধ কর।

সঞ্জয় উবাচ -

এতচ্ছ্রত্বা বচনং কেশবস্য কৃতাঞ্জলির্বেপমানঃ কিরীটা
নমস্কৃত্বা ভূয় এবাহ কৃষ্ণং সগদ্ গদং ভীতভীতঃ প্রণম্য।।৩৫

সঞ্জয় বলিলেন - শ্রীকৃষ্ণের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অর্জ্জুন কম্পিত কলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে কৃষ্ণকে নমস্কার করিলে; আবার অত্যন্ত ভীত হইয়া প্রণামপূর্বক গদ্‌গদ স্বরে বলিতে লাগিলেন।

অর্জ্জুন উবাচ -

স্থানে হৃষীকেশ তব প্রকীর্ত্ত্যা জগৎ প্রহৃষ্যত্যনুরজ্যতে চ
রক্ষাংসি ভীতানি দিশো দ্রবন্তি সর্ব্বে নমস্যন্তি চ সিদ্ধসঙ্ঘাঃ।।৩৬

অর্থঃ- (৩৬) অর্জ্জুন কহিলেন - হে হৃষীকেশ, তোমার মাহাত্ম্য কীর্ত্তনে সমস্ত জগৎ যে হৃষ্ট হয় এবং তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়, ইহা যুক্তিযুক্ত; রাক্ষসেরা যে তোমার ভয়ে ভীত হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করে, এবং সিদ্ধগণ যে তোমাকে নমস্কার করেন, তাহাও আশ্চর্য্য নহে।

কস্মাচ্চ তে ন নমেরন্ মহাত্মন্ গরীয়সে ব্রহ্মণোহপ্যাদিকর্ত্রে
অনন্ত দেবেশ জগন্নিবাস ত্বমক্ষরং সদসৎ তৎ পরং যৎ।।৩৭

অর্থঃ- (৩৭) হে মহাত্মন্‌, হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, তুমি ব্রহ্মারও গুরু এবং আদি কর্ত্তা; অতএব সমস্ত জগৎ কেন না তোমাকে নমস্কার করিবে। তুমি সৎ (ব্যক্ত জগৎ), তুমি অসৎ (অব্যক্ত প্রকৃতি) এবং সদসতে অতীত যে অক্ষর ব্রহ্ম তাহাও তুমি।

ত্বমাদিদেবঃ পুরুষঃ পুরাণস্ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্
বেত্তাসি বেদ্যঞ্চ পরঞ্চ ধাম ত্ব্যা ততং বিশ্বমনন্তরুপ।।৩৮

অর্থঃ- (৩৮) হে অনন্তরূপ, তুমি আদিদেব, তুমি অনাদি পুরুষ, তুমি এই বিশ্বের একমাত্র লয়স্থান, তুমি জ্ঞাতা, তুমিই জ্ঞাতব্য, তুমিই পরমধাম। তুমি এই বিশ্ব ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছ।

বায়ুর্যমোহগ্নির্বরুণঃ শশাঙ্ক প্রজাপতিস্ত্বং প্রপিতামহশ্চ
নমো নমস্তেহস্তু সহস্রকৃত্বঃ পুনশ্চ ভূয়োহপি নমো মনস্তে।।৩৯

অর্থঃ- (৩৯) বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র তুমিই; পিতামহ ব্রহ্মাও তুমি এবং ব্রহ্মার জনকও (প্রপিতামহ) তুমি। তোমাকে সহস্রবার নমস্কার করি, আবার পুনঃ পুনঃ তোমাকে নমস্কার করি।

প্রজাপতি, প্রপিতামহ - ব্রহ্মা হইতে মরীচি আদি মানস-পুত্রের উৎপত্তি মরীচি হইতে কশ্যপ এবং কশ্যপ হইতে সমস্ত প্রজার উৎপত্তি। ব্রহ্মা, মরীচি-আদির পিতা, এই জন্য তাঁহাকে পিতামহ বলা হয় এবং ব্রহ্মারও পিতা অর্থাৎ যিনি পরমেশ্বর তিনি প্রপিতামহ। কশ্যপদিকেও প্রজাপতি বলে। কিন্তু এখানে প্রজাপতি শব্দ একবচনান্ত থাকাতে উহার অর্থ ব্রহ্মা বলিয়াই গ্রহণ করা সঙ্গত।

নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোহস্তু তে সর্ব্বত এব সর্ব্ব
অনন্তবীর্য্যামিতবিক্রমস্ত্বং সর্ব্বং সমাপ্নোষি ততোহসি সর্ব্বঃ।।৪০

অর্থঃ- (৪০) তোমাকে সম্মুখে নমস্কার করি, তোমাকে পশ্চাতে নমস্কার করি; হে সর্ব্বস্বরূপ, সর্ব্বত্রই তুমি - তোমাকে সকল দিকেই নমস্কার করি; অনন্ত তোমার বলবীর্য্য, অসীম তোমার পরাক্রম। তুমি সমস্ত্ ব্যাপিয়া রহিয়াছ, সুতরাং তুমিই সমস্ত।

সখেতি মত্বা প্রসভং যদুক্তং হে কৃষ্ণ হে যাদব হে সখেতি
অজানতা মহিমানং তবেদং ময়া প্রমাদাৎ প্রণয়েন বাপি।।৪১
যচ্চাবহাসার্থমসৎকৃতোহসি বিহারশয্যাসনভোজনেষু
একোহথবাপ্যচ্যুত তৎসমক্ষং তৎ ক্ষাময়ে ত্বামহমপ্রমেয়ম্৪২

অর্থঃ- (৪১-৪২) তোমার এই বিশ্বরূপ এবং ঐশ্বর্যমহিমা না জানিয়া, তোমাকে সখা ভাবিয়া অজ্ঞানবশতঃ বা প্রণয়বশতঃ, হে কৃষ্ণ, হে মাধব, হে সখা, এইরূপ তোমায় বলিয়াছি; হে অচ্যুত, আহার, বিহার, শয়ন ও উপবেশনকালে একা অথবা বন্ধুজন সমক্ষে পরিহাসচ্ছলে তোমার কত অমর্য্যাদা করিয়াছি, অচিন্ত্যপ্রভাব তুমি, তোমার নিকট তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি।

পিতাসি লোকস্য চরাচরস্য ত্বমস্য পূজ্যশ্চ গুরুর্গরীয়ান্
ন ত্বৎসমোহস্ত্যভ্যধিকঃ কুতোহন্যো লোকত্রয়েহপ্যপ্রতিমপ্রভাবঃ।।৪৩

অর্থঃ- (৪৩) হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর সমস্ত লোকের পিতা; তুমি পূজ্য, গুরু ও গুরু হইতে গুরুতর; ত্রিজগতে তোমার তুল্য কেহই নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকিবে কি প্রকারে?

তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ং প্রসাদয়ে ত্বামহমীশমীড্যম্
পিতেব পুত্রস্য সখেব সখ্যুঃ প্রিয়ঃ প্রিয়ায়াহর্হসি দেব সোঢ়ুম্।।৪৪

অর্থঃ- (৪৪) হে দেব, পূর্ব্বোক্ত রূপে আমি অপরাধী, সেই হেতু দণ্ডবৎ প্রণামপূর্ব্বক তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করিতেছি। সকলের বন্দনীয় ঈশ্বর তুমি; পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা কর।

অদ্দৃষ্টপূর্ব্বং হৃষিতোহস্মি দৃষ্ট্বা ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে
তদেব মে দর্শয় দেব রূপং প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস।।৪৫

অর্থঃ- (৪৫) হে দেব, পূর্ব্বে যাহা কখনও দেখি নাই, সেই রূপ দেখিয়া আমার হর্ষ হইয়াছে বটে, কিন্তু ভয়ে মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে; অতএব, তোমার সেই (চির পরিচিত) পূর্ব্বরূপটা আমাকে দেখাও; হে দেবেশ, হে জগন্নিবাস, আমার প্রতি প্রসন্ন হও।

কিরীটিনং গদিনং চক্রহস্তমিচ্ছামি ত্বাং দ্রষ্টুমহং তথৈব
তেনৈব রূপেণ চতুর্ভূজেন সহস্রবাহো ভব বিশ্বমুর্ত্তে।।৪৬

অর্থঃ- (৪৬) আমি কিরীটধারী এবং গদা ও চক্রহস্ত তোমার সেই পূর্ব্বরূপই দেখিতে ইচ্ছা করি। হে সহস্রবাহো, বিশ্বমূর্ত্তে, তুমি সেই চতুর্ভূজ মূর্ত্তি ধারণ কর।

শ্রীভগবানুবাচ -

ময়া প্রসন্নেন তবার্জ্জুনেদং রূপং পরং দর্শিতমাত্মযোগাৎ
তেজোময়ং বিশ্বমনন্তমাদ্যং যন্মে ত্বদন্যেন ন দৃষ্টপূর্ব্বম্।।৪৭

অর্থঃ- (৪৭) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন, আমি প্রসন্ন হইয়া স্বকীয় যোগ প্রভাবেই এই তেজোময়, অনন্ত, আদ্য, বিশ্বাত্মক পরমরূপ তোমাকে দেখাইলাম; আমার এই রূপ তুমি ভিন্ন পূর্ব্বে কেহ দেখে নাই।

ন বেদযজ্ঞাধ্যয়নৈর্নদানৈ র্নচ ক্রিয়াভির্ন তপোভিরুগ্রৈঃ
এবংরূপঃ শক্য অহং নৃলোকে দ্রষ্টুং ত্বদন্যেন কুরুপ্রবীর।।৪৮

অর্থঃ- (৪৮) হে কুরুপ্রবীর, না বেদাধ্যয়ন দ্বারা, না যজ্ঞবিদ্যার অনুশীলন দ্বারা, না দানাদি ক্রিয়াদ্বারা, না উগ্র তপস্যা দ্বারা মনুষ্যলোকে তুমি ভিন্ন আর কেহ আমার ঈদৃশ রূপ দেখিতে সক্ষম হয়।

মা তে ব্যথা মা চ বিমুঢ়ভাবো দৃষ্ট্বা রূপং ঘোরমীদৃঙ্ মমেদম্
ব্যপেতভীঃ প্রীতমনাঃ পুনস্ত্বং তদেব মে রূপমিদং প্রপশ্য।।৪৯

অর্থঃ- (৪৯) তুমি আমার এই ঘোর রূপ দেখিয়া ব্যাথিত হইও না, বিমূঢ় হইও না, ভয় ত্যাগ করিয়া প্রীত মনে পুনরায় তুমি আমার পূর্ব্বরূপ দর্শন কর।

সঞ্জয় উবাচ -

ইত্যর্জ্জুনং বাসুদেবস্তথোক্ত্বা স্বকং রূপং দর্শয়ামাস ভূয়ঃ
আশ্বাসয়ামাস চ ভীতমেনং ভূত্বা পুনঃ সৌম্যবপুর্মহাত্মা।।৫০

অর্থঃ- (৫০) সঞ্জয় বলিলেন - বাসুদেব অর্জ্জুনকে এই বলিয়া পুনরায় সেই স্বীয় মূর্ত্তি দেখাইলেন; মহাত্মা পুনরায় প্রসন্ন মূর্ত্তি ধারণ করিয়া ভীত অর্জ্জুনকে আশ্বস্ত করিলেন।

অর্জ্জুন উবাচ -

দৃষ্ট্বেদং মানুষং রুপং তব সৌম্যং জনার্দ্দন
ইদানীমস্মি সংবৃত্তঃ সচেতাঃ প্রকৃতিং গতঃ।।৫১

অর্থঃ- (৫১) অর্জ্জুন বলিলেন - হে জনার্দ্দন, তোমার এই সৌম্য মানুষ রূপ দর্শন করিয়া আমি এখন প্রসন্নচিত্ত ও প্রকৃতিস্থ হইলাম।

শ্রীভগবানুবাচ -

সুদুর্দ্দশমিদং রূপং দৃষ্টবানসি যন্মম
দেবা অপ্যস্য রূপস্য নিত্যং দর্শনকাঙ্ক্ষিণঃ।।৫২

অর্থঃ- (৫২) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - তুমি আমার যে রূপ দেখিলে উহার দর্শন লাভ একান্ত কঠিন; দেবগণও সর্ব্বদা এই রূপের দর্শনাকাঙ্ক্ষী।

নাহং বেদৈর্ন তপসা ন দানেন ন চেজ্যয়া
শক্য এবংবিধো দ্রষ্টুং দৃষ্টবানসি মাং যথা।।৫৩

অর্থঃ- (৫৩) আমাকে যেরূপ দেখিলে এই রূপ বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, ধ্যান, যজ্ঞ, কোন কিছু দ্বারাই দর্শন করা যায় না।

ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জ্জুন
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুঞ্চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুঞ্চ পরন্তপ।।৫৪

অর্থঃ- (৫৪) হে পরন্তপ, হে অর্জ্জুন, কেবল অনন্যা ভক্তি দ্বারাই ঈদৃশ আমাকে স্বরূপতা জানিতে পারা যায়, সাক্ষাৎ দেখিতে পারা যায়, এবং আমাতে প্রবেশ করিতে পারা যায়।

একমাত্র অনন্যা ভক্তি দ্বারাই পরমেশ্বরের স্বরূপ জ্ঞান হয়, তাঁহার সাক্ষাৎকার হয় এবং পরিশেষে তাঁহার সহিত তাদাত্ম্য লাভ হয়। এই শেষ অবস্থাকে ভক্তিশাস্ত্রে অধিরূঢ়ভাব বলে (১৮।৫৫ দ্রষ্টব্য)।

মৎকর্ম্মকৃন্মৎপরমো মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জ্জিতঃ
নির্ব্বৈরঃ সর্ব্বভূতেষু যঃ স মামেতি পাণ্ডব।।৫৫

অর্থঃ- (৫৫) হে পাণ্ডব, যে ব্যক্তি আমারই কর্ম্মবোধে সমুদয় কর্ম্ম করেন, আমিই যাহার একপাত্র গতি, যিনি সর্ব্বপ্রকারে আমাকে ভজনা করেন, যিনি সমস্ত বিষয়ে আসক্তিশূন্য, যাহার কাহারও উপর শত্রুভাব নাই, তিনিই আমাকে প্রাপ্ত হন।

ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে বিশ্বরূপদর্শন-যোগো নামৈকাদশোহধ্যায়ঃ।।

No comments:

Post a Comment